চীনে মাদকের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ এবং জটিল। মূলত, আফিম নিয়ে বিতর্ক এবং যুদ্ধের কারণে এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উনিশ শতকে ব্রিটিশরা চীনে আফিম পাচার করতো, যার ফলে চীনে ব্যাপক মাদকাসক্তি ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ফলস্বরূপ দুটি আফিম যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
ব্রিটিশরা বাণিজ্যিক কারণে চীনে আফিম নিয়ে আসে, যা পরবর্তীতে চীনা সমাজে ব্যাপক ধ্বংস ডেকে আনে। ব্রিটিশ বণিকরা আফিম বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে, ফলে চীনে মাদকাসক্তি বৃদ্ধি পায়। প্রথম ও দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল আফিম নিষিদ্ধ করার জন্য চীনা সরকারের প্রচেষ্টা এবং ব্রিটিশদের আফিম ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
আফিম ব্যবহার চীনের সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল, যার মধ্যে ছিল স্বাস্থ্যহানি, অর্থনৈতিক সংকট এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা।
মাদকের বিরুদ্ধে চীনের সরকারের পদক্ষেপ:
চীন সরকার মাদকদ্রব্যের বিস্তার রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
# মাদক দ্রব্য নিষিদ্ধ করা ও এর ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ।
# মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন।
# মাদক বিরোধী জনসচেতনতা তৈরি।
বর্তমানে চীন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতি অনুসরণ করে এবং মাদক পাচার ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে তারা সেই বদনাম ঘুচিয়ে এখন সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
মাদকদ্রব্য বলতে এমন বস্তুসমূহকে বুঝায় যেগুলো শরীরে প্রবেশ করলে কিছু স্নায়বিক প্রতিক্রিয়ার উদ্রেক ঘটে এবং বারবার এসব দ্রব্য গ্রহণে আগ্রহ জন্মায়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গবেষকদের তথ্যমতে নতুন চার ধরনের মাদকসহ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ২৭ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে।
এগুলো হলো- ম্যাজিক মাশরুম, ডায়মিথাইলট্রিপ্টামাইন (ডিএমটি), লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড (এলএসডি), ক্রিস্টাল মেথ বা আইস বা মেথামফিটামিন, এস্কাফ সিরাপ, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, প্যাথিডিন, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, বুপ্রেনরফিন (টি.ডি. জেসিক ইঞ্জেকশন), ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন (বনোজেসিক ইনজেকশন), মরফিন, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন।
এ ছাড়াও বিভিন্ন বৈধ ড্রাগ একসঙ্গে মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে মাদক। এসবও সেবন হচ্ছে দেদারছে।
একজন মাদকসেবী যে মাদকটা নিয়মিত গ্রহণ করে, সেটি না পেলে হাতের কাছে যা পায় তাই নিয়ে নেয়। মাদকসেবীরা বৈধ ড্রাগেরও অপব্যবহার করে থাকে।
ইসলাম সকল প্রকার মাদক তথা নেশাদার দ্রব্য হারাম ঘোষণা করেছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক নেশাদার দ্রব্যই মদ, আর যাবতীয় মদই হারাম’।
অথচ এই মাদকের ভয়ংকর থাবায় আজ বিশ্বব্যাপী বিপন্ন মানব সভ্যতা। এর সর্বনাশা মরণ ছোবলে আমাদের জাতি আজ অকালে ধ্বংস হয়ে যচ্ছে। ভেঙ্গে পড়ছে অসংখ্য পরিবার। বিঘ্নিত হচ্ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বৃদ্ধি পাচ্ছে চোরাচালানসহ মানবতা বিধ্বংসী অসংখ্য অপরাধ।
মাদকাসক্তির কারণে সকল জনপদেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস বেড়ে গিয়ে মানুষের জান-মাল ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। সমাজের অধিকাংশ অপরাধের জন্য মুখ্যভাবে দায়ী এই মাদকতা।
এজন্য রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন- মদ পান করো না। কেননা তা সকল অপকর্মের চাবিকাঠি।
অন্য হাদীছে এসেছে- তোমরা মদ থেকে বেঁচে থাক। কেননা তা অশ্লীল কাজের মূল।
আমার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- মাদক ব্যবসায়ী, মাদকসেবী একটি বিশাল সংঘবদ্ধ চক্র। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত এদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। মাদক কেনা-বেচায় তাদের চেন সিষ্টেম আছে। আবার কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের মিটিং মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য টাকার সাথে সাথে মাদক পরিবেশন করতেও দেখেছি। মাদক নিয়ন্ত্রণ ও মাদক উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত অনেক সরকারি লোকদের সাথে মাদক ব্যবসায়ীদের গোপন আঁতাত করতেও দেখেছি। মাদক ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজের অনেক তথাকথিত নামীদামি লোকজন, রাজনীতিবিদ, আমলাকামলাদের জড়িত থাকার ঘটনা অনেকেই জানে। এমন অনেক কথা আমি জানি, যা অধিকাংশ মানুষ চিন্তা করতেও পারে না।
আমাদের দেশে বর্তমানে আর এক ভয়ংকর মাদকের উদ্ভব হয়েছে। তা হলো – মোবাইল মাদক। অর্থাৎ মোবাইলের নেশা। অনলাইন গেম ও অনলাইন জুয়া এই মাদকের অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের শহর-বন্দরে, গ্রাম-গঞ্জে অনলাইন মাদক মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েসহ যুবসমাজ ও বয়স্কদের মধ্যেও অনলাইন মাদক ঢুকে পড়েছে। এখান থেকে এখনই পুরা জাতিকে উদ্ধার করতে হবে। নইলে অচিরেই আমাদের দেশ প্রাচীন চীনের মতো আফিম যুদ্ধের সম্মুখীন হবে। সেই যুদ্ধ থেকে জাতিকে ফিরিয়ে আনতে যুগ যুগ কেটে যাবে।
আসুন, সকলে মিলে জাতিকে মাদকের আগ্রাসন থেকে ফিরিয়ে আনি।
খুলনা গেজেট/এএজে